হজ্জ – ওমরাহ করার পুর্বে কি কি প্রস্তুতি নিতে হবে ?

হজ্জ-ওমরাহ কষ্টসাধ্য ইবাদত। হজ – ওমরাহ  জন্য আর্থিক প্রস্তুতির সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক প্রস্তুতিও জরুরি। কারণ শারীরিক সক্ষমতা না থাকলে হজের   বিধানগুলো যথাযথভাবে পালন করা সম্ভব নয়। হজ-ওমরার জন্য বিশেষ কিছু বিষয়ের প্রস্তুতি আবশ্যক। তা হলো-

১. আকিদা-বিশ্বাসের সংশোধন  : সঠিক আকিদা-বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত মুসলিম জীবন। যার আকিদা ঠিক নেই তার জীবন ব্যর্থ। মুসলিম ব্যক্তির প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে, নিজেদের আকিদা-বিশ্বাস বিশুদ্ধ করা। মহান আল্লাহ বলেন,

وَ مَنۡ یَّکۡفُرۡ بِالۡاِیۡمَانِ فَقَدۡ حَبِطَ عَمَلُهٗ ۫ وَ هُوَ فِی الۡاٰخِرَۃِ مِنَ الۡخٰسِرِیۡنَ

 ‘যে ব্যক্তি বিশ্বাসের সঙ্গে কুফরি করবে, তার আমল নষ্ট হয়ে যাবে। সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাবে।’ (সুরা মায়েদা : আয়াত ৫)

হজের   মতো ফরজ ইবাদত পালনের আগে প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের আকিদা-বিশ্বাস বিশুদ্ধ করা জরুরি। কুফরি, শিরকি, বিদাতি ও ভ্রান্ত আকিদা-বিশ্বাস থেকে বেরিয়ে আসা একান্ত আবশ্যক।         

মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও অনেক মুসলিম যেমন মসজিদে যায়, তেমনি তারা মাজারে গিয়ে সেজদা করে আবার মক্কায় যেমন যায়, তেমনি তারা মন্দিরেও যায়। সমাজে এদের সংখ্যা কম নয়। মহান আল্লাহ বলেন,

وَ مَا یُؤۡمِنُ اَکۡثَرُهُمۡ بِاللّٰهِ اِلَّا وَ هُمۡ مُّشۡرِکُوۡنَ

 ‘তাদের অধিকাংশ; যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে, তারা মুশরিক।’ (সুরা ইউসুফ : আয়াত ১০৬)

তাই হজ-ওমরাসহ ইসলামে বিশ্বাসী ব্যক্তির জন্য শিরকমুক্ত ঈমানি চেতনা জরুরি। তবেই বান্দার ছোট-বড় সব আমল আল্লাহর কাছে কবুল হবে। কারণ আকিদার-বিশ্বাসের উপর সব আমল কবুল হওয়া নির্ভরশীল। নবিজী বলেছেন-

إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ

 ‘সব আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল।’( বুখারী )

এজন্য বলা হয়, বিশুদ্ধ আকিদা দ্বীন ইসলামের শিকড় এবং মুসলিম মিল্লাতের সুদৃঢ় ভিত্তি।’

২. বৈধ সম্পদ সংগ্রহ: ইবাদত কবুলের পূর্ব শর্ত হচ্ছে, হালাল রুজি তথা অর্থ সংগ্রহ। হজ-ওমরার জন্য এর বিকল্প নেই। নবিজী বলেছেন-

إِنَّ اللهَ طَيِّبٌ لَا يَقْبَلُ إِلَّا طَيِّبًا

 ‘নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পবিত্র, তিনি পবিত্র বস্তু ছাড়া কবুল করেন না।’ (মুসলিম)

কারো খাদ্য, পানীয় ও পোশাক হারাম হলে তার কোনো ইবাদত গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই প্রত্যেকের সতর্ক থাকতে হবে, খাদ্য, পানীয়, পোশাক ও আসবাব-পত্র হালাল নাকি হারাম। কোনো ধরনের দুর্নীতি ও অপরাধের মাধ্যমে অর্জিত অর্থে হজ-ওমরা করা হলে তা কবুল হবে না।

৩. হজ্জ  ও উমরাহ্‌  প্রশিক্ষণঃ হজে যাওয়ার আগে হজ-ওমরাহ সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ নেওয়া জরুরি। প্রশিক্ষণ ছাড়া হজে গেলে এর রোকন ও বিধানগুলো যথাযথভাবে পালন করা কঠিন হয়ে পড়ে। অনেকে ভুল করে ফেলেন। যে কারণে অনেকের কাফফারা গুনতে হয়। এ জ্ঞান না থাকার ফলে অনেকের হজ্জ  সম্পাদনও হয় না। এ জন্য যোগ্য সঙ্গী তথা আলেম-ওলামার সঙ্গে হজে যাওয়ার বিকল্প নেই।

৪. হজ্জ  ও উমরাহ্‌ কাফেলা: হজে যাওয়ার জন্য যোগ্য কাফেলার বিকল্প নেই। যারা হজে যাবেন, তাদের হজ-ওমরাহ সম্পর্কিত বিষয়াবলী তদারকির জন্য যোগ্যতা সম্পন্ন মুয়াল্লিম বা গাইড আবশ্যক। উপযুক্ত কাফেলা সংঘটিত না হলে সুন্দরভাবে হজ্জ  সম্পাদন করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই সুন্দরভাবে হজ্জ  সম্পাদনের জন্য উত্তম কাফেলা গঠন করা জরুরি। হাদিসে ভালো মানুষের সংস্পর্শের কথা বলা হয়েছে এভাবে-

وعن أبي موسى الأشعري رضي الله عنه أن النبي صلى الله عليه وسلم قال: «مثل صحابة الصدق وجليس الخائن مثل البائع والحداد». كونك بائع عطور فإما أن يمنحك العطر؛ أو ستشتري منه العطر؛ أو على الأقل سوف تشمه. ومن ناحية أخرى، فإن الحداد إما أن يحرق ملابسك؛  وإلا فإنك تجد له رائحة كريهة

হজরত আবু মুসা আশআরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘সৎ সঙ্গী ও অসৎ সঙ্গীর উদাহরণ হচ্ছে- আতর বিক্রেতা ও কামারের মতো। আতর বিক্রেতা হচ্ছে হয় সে তোমাকে আতর দেবে; না হয় তুমি তার কাছ থেকে আতর কিনবে; আর না হয় তুমি অন্তত তার কাছে সুঘ্রাণ পাবে। পক্ষান্তরে কামার হচ্ছে- হয় সে তোমার কাপড় পুড়িয়ে দেবে;  আর না হয় তুমি তার কাছে দুর্গন্ধ পাবে।’ (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত)

তাই হজের    জন্য যদি আলেম-ওলামা সমৃদ্ধ যোগ্য কাফেলা পাওয়া যায় তবে কাফেলার অন্যান্য সদস্যরা সুন্দর ও উত্তমভাবে হজ্জ  সম্পাদন করতে সক্ষম হবে।

. হজ্জ-ওমরার আহকাম জেনে নেওয়া: নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেখানো পদ্ধতি ও রীতি-নীতিতে হজ্জ  সম্পাদন করতে হবে। হজের   জন্য প্রয়োজনীয় হুকুম-আহকাম, নিয়ম-পদ্ধতিগুলো সঠিকভাবে জেনে নিতে হবে। নবিজী পদ্ধতি অনুসরণ করা ছাড়া হজ্জ  করলে তা কবুল হবে না। হাদিসে এসেছে-

تعلموا مني آداب الحج

‘তোমরা তোমাদের হজের   পদ্ধতি (নিয়ম, রীতি-নীতি) আমার কাছ থেকে গ্রহণ করো।’ (বাইহাকি, মুসলিম, মিশকাত)

হজ্জের সময় যেসব জিনিসপত্র সঙ্গে নিবেন

  • বেশি মালামাল নিয়ে আপনার বোঝা ভারী করবেন না, আবার কম নিয়ে অপ্রস্তুতও হবেন না।
  • মজবুত চাকাওয়ালা মাঝারি বা বড় আকারের ১টি ব্যাগ/লাগেজ সঙ্গে নিবেন।
  • মুল্যবান জিনিসপত্র (টাকা, টিকেট, পাসপোর্ট ইত্যাদি) রাখার জন্য ১টি কোমর/কাঁধ/সৈনিক ব্যাগ নিন। 
  • পাসপোর্ট হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সেজন্য আপনার পাসপোর্টের ফটোকপি নোটারি করে নিন এবং বিমানের টিকেট ও মেডিকেল সার্টিফিকেটের ফটোকপি করে নিন। বাসায়ও এর কপি রেখে যান।
  • অতিরিক্ত ১০ কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি ও ১০ কপি স্ট্যাম্প সাইজের রঙ্গিন ছবি সঙ্গে নিন। 
  • সালাতের মুসাল্লা বা কাপড়, কাপড় শুকানো দড়ি, ব্যাগ বাঁধার জন্য কিছু ছোট দড়ি সঙ্গে রাখুন।
  • পড়ার জন্য ছোট আকারের কুরআন কোরআন শরিফ ও কিছু জরুরী কিতাব এবং লোকেশন ম্যাপ সঙ্গে রাখুন।
  • যোগাযোগ এর জন্য সাধারণ মোবাইল অথবা এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোন সঙ্গে থাকলে ভালো হয়। অনলাইনে Messenger অথবা WhatsApp এ ভালো ভালো ভাবে কথা বলতে অসুবিধা হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে আপনারা VPN ব্যবহার করে IP Address পরিবর্তন করে খুবি ভালো এবং সুন্দর ভাবে কথা বলতে পারেন। আমরা আপনাকে সাজেশন করবো Enova VPN ব্যাবহার করার জন্য।
  • ২ টি কোমল স্লিপার সেন্ডেল এবং এগুলো রাখার জন্য ছোট পাতলা কাপড়ের একটি ব্যাগ। 
  • ব্যক্তিগত ব্যবহারের জিনিসপত্র: ব্রাশ, পেস্ট, টয়লেট পেপার, আয়না, চিরুনি, তেল, সাবান, তোয়ালে, শ্যাম্পু, নোটবুক, পারফিউম, ভ্যাসলিন, লোশন ও ডিটারজেন্ট ইত্যাদি সাথে নিন। তবে ইহরাম অবস্থায় ব্যবহার করার জন্য সেসব প্রসাধনী সুগন্ধহীন হতে হবে। 
  • একটি দেশের পতাকা, এলার্ম ঘড়ি/হাত ঘড়ি, রোদ চশমা, মার্কার পেন।
  • পর্যাপ্ত ওষুধপত্র, কিছু দরকারি এন্টিবায়োটিক, ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র অনুসারে ভ্রমণের জন্য দরকারি কিছু ওষুধ।
  • ব্যাগের নিরাপত্তার জন্য সঙ্গে ছোট আকারের তালা-চাবি নিন এবং কিছু পলিথিন ব্যাগও নিন।
  • দরকারি জিনিসপত্র (টাকা, টিকেট, পাসপোর্ট, হজের পরিচয়পত্র, ক্রেডিট কার্ড) সবসময় হাতের কাছে এবং নিরাপদ স্থানে রাখবেন।
  • পশু যবেহ (হাদী) বা ফিদিয়ার জন্য ৫০০-৬০০ সৌদি রিয়াল আলাদা করে রাখতে ভুলবেন না। 
  • সঙ্গে কিছু বাংলাদেশী টাকাও রাখবেন।
  • একটি সাধারণ পরামর্শ হলো : আপনার নাম, পাসপোর্ট নম্বর, হজ পরিচয়পত্র নম্বর, যোগাযোগের মোবাইল অথবা ফোন নম্বর, ট্রাভেল এজেন্টের নাম ও নং, হোটেলের নাম ও ঠিকানা, যে কোনো নিকট আত্মীয়ের নাম ও ঠিকানা ও মুয়াল্লিম নং আপনার সকল ব্যাগে ইংরেজিতে লিখে রাখবেন।
  • কিছু শুকনো খাবার যেমন-চিড়া, গুড়, বিস্কুট, বাদাম, ড্রাই কেক, ইত্যাদি সঙ্গে রাখুন।
  • হজে যাওয়ার সময় আপনার মালামালের একটি তালিকা করুন ও তালিকা চেক করুন।
  • হজে যাওয়ার সময় আপনার বড় লাগেজের আদর্শ ওজন হবে ৮ থেকে ১০ কেজি।
  • [পুরুষদের জন্য] 

ইহরামের জন্য দুই সেট সাদা কাপড়।

ইহরামের কাপড় বাধার জন্য কোমর বেল্ট।

মাথা মুড়ানোর জন্য ১/২টি রেজার অথবা ব্লেড। তবে তা কোনোক্রমেই হাতের ব্যাগে রাখবেন না।

উপযুক্ত ও আরামদায়ক: প্যান্ট, শার্ট, ট্রাউজার, লুঙ্গি, টি-শার্ট, আন্ডারওয়্যার, পাঞ্জাবি, স্যান্ডেল, মোজা, জুতা, টুপি ইত্যাদি।

  • [মহিলাদের জন্য] 

পরিষ্কার ও আরামদায়ক সালওয়ার-কামিজ, স্কার্ফ, হিজাব।

পুরো যাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত কাপড়।

লেডিস ন্যাপকিন, সেফটি পিন, কেঁচি, টিস্যু, স্যান্ডেল, মোজা ও জুতা ইত্যাদি।

মনে রাখতে হবে-

হজ্জ  ও ওমরার অর্থ হলো, মহান রবের সন্তুষ্টি অর্জন করা। তাই আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে নবিজীর দেখানো রীতি-নীতি অনুযায়ী নির্ধারিত কার্যক্রম সম্পাদন করা। বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করা। সাফা-মারওয়া সায়ী করা। মাথার চুল মুন্ডন করা এবং আরাফা, মিনা, মুজদালেফায় অবস্থান ও কাজগুলো সম্পাদন করা জরুরি।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে হজ-ওমরার কাজগুলো যথাযথভাবে আদায় করার লক্ষ্যে উল্লেখিত প্রস্তুতিগুলো সম্পাদন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

আমরা যারা হজ্জ উমরাহ্‌ করার নিয়ত করেছি তাদের প্রত্যেকেরই হজ্জ উমরাহ্‌ করার যাবতীয় নিয়ম কানুন সম্পর্কে গভীর জ্ঞান থাকা জরুরী। আমাদের সম্পূর্ণ লেখাটি পড়লে কিভাবে উমরাহ্‌ করতে হয় সেই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পারবেন ইন-শা-আল্লাহ্‌।

Leave a comment